গোপাল কিভাবে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন
গোপালের মাধ্যমে পালবংশের প্রতিষ্ঠা শুধু একটি নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা নয় বরং, এটি বাংলার অরাজকতার অবসানও ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় দীর্ঘ সময় ধরে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেশের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেছিল।
ঠিক এই পরিস্থিতিতেই গোপাল বাংলার আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হন এবং দেশকে অরাজকতার কবল থেকে মুক্ত করেন। নিচে তাঁর ক্ষমতা অর্জনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো।
গোপাল কিভাবে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন
গোপাল এমন এক সময়ে ক্ষমতা দখল করেন যখন বাংলায় এক ভয়াবহ অরাজক অবস্থায় নিমজ্জিত ছিল। এই সময় ‘বড় মাছ ছোট মাছকে খায়’–এই প্রবাদের মতো শক্তিশালী শ্রেণির মানুষ দুর্বলদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিল।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তপ্রভুরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল যেটি বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ শান্তি এবং শৃঙ্খলার প্রত্যাশায় একতাবদ্ধ হয়ে গোপালকে রাজা নির্বাচিত করে।
খলিমপুর তাম্রশাসনে বলা আছে যে বাংলার ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ বা জনগণই গোপালকে তাদের শাসক হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, স্থানীয় সামন্তপ্রভুরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অরাজকতা বন্ধ করে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য গোপালকে সমর্থন করেন।
তবে, ড. আব্দুল মমিন চৌধুরী তাঁর "Dynastic History of Bengal" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে গোপালের ক্ষমতা লাভের এই গল্পকে কিছুটা কাল্পনিক বলে মনে হতে পারে। তাঁর মতে, প্রজাদের দ্বারা গোপালের নির্বাচনের ধারণা কিছুটা অতিরঞ্জিত হতে পারে।
বাস্তবে, সামন্তশ্রেণির অভ্যন্তরীণ সমঝোতাই গোপালের ক্ষমতা দখলের পেছনে মূল চালিকা শক্তি হতে পারে। গোপালের ক্ষমতা লাভ নিয়ে একটি প্রচলিত লোককাহিনি আছে যেটি তাঁকে দেবী চণ্ডীর ভক্ত হিসেবে উল্লেখ করে।
এই কাহিনি অনুসারে, গোপালের নাকি অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, যার ফলে তিনি নাগকে ধ্বংস করতে পারতেন। এমন বিশ্বাস থেকেই সাধারণ মানুষ তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেয় এবং তাঁকে রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
উপসংহার
গোপালের ক্ষমতা লাভের ঘটনাকে ঘিরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য ও কাহিনি পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, এটি জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছার ফল, আবার অনেকে বিশ্বাস করেন যে, ক্ষমতালোভী সামন্তপ্রভুরা নিজেদের স্বার্থেই তাঁকে ক্ষমতায় বসায়।
তবে যা-ই হোক না কেন, গোপালের নিজস্ব যোগ্যতা, কৌশলগত দক্ষতা এবং সঠিক সময়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাই তাঁকে বাংলার প্রথম পালরাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর শাসন কেবল অরাজকতার অবসান ঘটায়নি, বরং বাংলা অঞ্চলে নতুন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিও স্থাপন করে।
অতএব, গোপালের রাজ্যাভিষেক কেবল একজন শাসকের ক্ষমতা লাভ নয়, এটি ছিল বাংলার একটি নতুন যুগের সূচনা যেটি বহু শতাব্দী ধরে বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।